শিরোনাম

২০শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ভোর ৫:০৪

স্বামীকে বাঁচাতে একাই লড়ছেন ৭০ বছরের পিয়ারা বেগম

প্রকাশিত: এপ্রিল ৮, ২০২৪ ৮:০৯ অপরাহ্ণ
Print Friendly and PDF

বরিশাল অফিস:: এক বছর আগে মিনি স্ট্রোক করা পিয়ারা বেগমের সব থাকতেও যেন কিছুই নেই। বার্ধক্যজনিত নানা রোগে শয্যাশায়ী হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন স্বামী আব্দুল মালেক। তার চিকিৎসার খরচ যোগাতে একাই লড়ছেন ৭০ বছর বয়সী পিয়ারা বেগম।

বরগুনা পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের শহীদ স্মৃতি সড়কের বরিয়ালপাড়া এলাকায় বসবাস করেন পিয়ারা বেগম। প্রায় ৩০ বছর আগে তার স্বামী আব্দুল মালেক পৌরসভার ঝাড়ুদার হিসেবে নিযুক্ত হন। স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সংসারের অতিরিক্ত খরচ বহন করতে রাতে রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার পাশাপাশি দিনের বেলায় বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও দোকানে পানি দেওয়ার কাজও করতেন তিনি। পরবর্তীতে সংসারের হাল ধরতে স্বামীর সঙ্গে পিয়ারা বেগমও যুক্ত হন কাজে। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে তিনিও পৌরসভার রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার কাজ কাজ করছেন।

দীর্ঘ বছর কাজ করে মালেক এখন বয়সের ভারে অসুস্থ হয়ে ৬ মাস ধরে শয্যাশায়ী। আগের মতো আর চোখেও দেখেন না তিনি। পিয়ারা বেগমও একবার স্ট্রোক করে বেঁচে ফিরে চলছেন লাঠি ভর দিয়ে। ছেলে-মেয়েরা ব্যস্ত তাদের যে যার সংসার নিয়ে। এক টাকাও খরচ দেন না বাবা-মায়ের সংসারে। স্বামী ও নিজের চিকিৎসা খরচ এবং তিন বেলা খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে বাধ্য হয়ে রাতে ঝাড়ু হাতে লাঠি ভর দিয়ে রাস্তায় নামছেন পিয়ারা। তবে যে টাকা বেতন পান তা দিয়ে একজনের ওষুধ কিনতেই হিমশিম খেতে হয় তাকে। অনেক সময় টাকা না থাকায় ১৫ দিনেও ওষুধ জোটে না তাদের।

সরেজমিনে বরগুনা পৌর শহরের বাজার রোড এলাকা ঘুরে দেখা যায়, রাস্তায় মানুষের ব্যস্তাতা কমার পরেই লাঠি ভর দিয়ে রাস্তা ঝাড়ু দিতে নেমে পড়েছেন পিয়ারা বেগম। ঠিকমতো চোখে না দেখায় চশমা পড়ে কাজ করছেন তিনি। এছাড়াও একটু কাজ করেই হাঁপিয়েও উঠছেন তিনি। শরীর না চাইলেও তিন বেলা খাবার জোটাতে, নিজের ও স্বামীর চিকিৎসার খরচ যোগাতে কাজ করে যাচ্ছেন পিয়ারা বেগম।

কাজের সুবাদে প্রতিদিন রাতে বাড়ি ফেরা সাইদুল শিকদার নামে এক এনজিও কর্মী বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই পিয়ারা খালাকে রাস্তা ঝাড়ু দিতে দেখি। তার যে অবস্থা তাতে এই বয়সে এখন তার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব না। তার স্বামী সেও অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে তিনি এ কাজ করেন। অন্য কোনো কাজ করতে না পারায় শুধু ঝাড়ু দিয়ে পৌরসভা থেকে যে টাকা পান তা দিয়ে তাদের চলে না।

পৌরসভার বাজার রোড এলাকার দীর্ঘদিনের ব্যবসায়ী সুকুমার দত্ত বলেন, আমি ছোটবেলা থেকে তার স্বামী ও তাকে রাস্তা ঝাড়ু দিতে দেখি। তার স্বামী অসুস্থ তিনিও অসুস্থ, কেউই এখন ঠিকমতো চোখেও দেখেন না।

পিয়ারা বেগমের তিন ছেলের মধ্যে জাকির এখন বাবার পরিবর্তে যুক্ত হয়েছেন পৌরসভার রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার কাজে। এছাড়াও তিনি দিনের বেলায় শ্রমিকের কাজ করে মাসে প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় করেন। তার আয়ের এক টাকাও দিচ্ছেন না বৃদ্ধ মা-বাবাকে। ঈদের সময়ে মা-ছেলে দুজনে মিলে যে সব রাস্তা ঝাড়ু দিয়েছেন সেখানকার ব্যবসায়ীরা খুশি হয়ে যে টাকা বকশিস দিয়েছেন তাও ভাগ করে নিয়েছেন সমান ভাগে। অপরদিকে অন্য দুই ছেলের মধ্যে বাদল কাজ করেন শ্রমিকের, আর জাফর নামে আরেক ছেলে কাজ করেন বালুর জাহাজে। তারাও যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত।

বৃদ্ধ বাবা-মাকে কোনো খরচ না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে ছেলেদের মধ্যে জাকির বলেন, পৌরসভায় কাজ করে যে বেতন পাই তা দিয়ে আমাদেরই খরচ হয় না। ছেলে-মেয়ে তারপরে মা-বাবার জন্য কীভাবে কী করব তা বুঝি না।

অসহায় পিয়ারা বেগম অসহায়ত্বের বর্ণনা দিয়ে বলেন, আমার এই বয়সে রাস্তায় ঝাড়ু দিয়ে খেতে হয়। আমার স্বামীকে কীভাবে খাওয়াব? তার ওষুধ কিনতে পারি না। মানুষের কাছে টাক চাইয়া যা পাই তা দিয়ে ওষুধ কিনে স্বামীকে খাওয়াই আবার আমি নিজেও খাই। কিন্তু সবাই তো আর সব সময় টাকা দেয় না। কেউ ১৫ দিন বা ১ মাস পরে কিছু টাকা দেয় তা দিয়ে কিছুই হয় না। কোনো কোনো দিন খাবার জোটাতে না পেরে না খেয়ে থাকতে হয়। নিয়মিত ওষুধ না খাওয়ায় আমার স্বামী ও আমি দুজনেই এখন আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছি। ছেলে-মেয়েরা যে টাকা আয় করে তা দিয়ে নিজেরাই চলতে পারে না আমাদেরকে তারা টাকা দেবে কীভাবে। তিন বেলা খাবার জোটাতেই আমার কষ্ট হয়। ঈদের সময় যে একটু সেমাই রান্না করে স্বামীকে খাওয়াব তাও আমি পারি না।

বরগুনা পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. সাইদুর রহমান সজীব বলেন, পিয়ারা বেগমকে পৌরসভার বেতন ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা করা হয়। পৌরসভার ভিজিএফসহ বরাদ্দকৃত চাল দিয়েও তাকে সহযোগিতা করা হয়। অসহায় পিয়ারা বেগমকে সহযোগিতা করতে পৌরসভার পাশাপাশি সমাজে যারা বিত্তশালী ও সামর্থ্যবান রয়েছেন তাদেরকেও তিনি এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

এ বিষয়ে বরগুনা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শামীম মিঞা বলেন, অসহায় অনেকেই আমাদের কাছে আসেন না। এ কারণে অনেকের তথ্য আমরা পাই না। পিয়ারা বেগমের সব তথ্য পেলে এবং তিনি যদি উপজেলা প্রশাসনের কোনো ধরনের সহযোগিতা ও বরাদ্দকৃত ভাতা না পেয়ে থাকেন তাহলে তাকে তা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়াও যদি প্রয়োজন হয় আমাদের অপ্রত্যাশিত আয়ের মাধ্যমে পিয়ারা বেগমকে প্রতি মাসে কিছু পরিমাণ আর্থিক সহযোগিতা দেয়ার চেষ্টা করব।